ঢাকা ০১:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি/নোটিশ ::
সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||   সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে... আগ্রহীরা সিভি মেইল করুন:  career@bdnewspost.com  ||
সদ্য প্রাপ্ত খবর ::
আজ খুলনার প্রবীণ সাংবাদিক, লোক গবেষক ও অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী bdnewspost.com Dakhil Math Query Resolution 2025 – Dakhil Math MCQ Query resolution 2025 PDF Obtain bdnewspost.com দাখিল গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন ও সমাধান ২০২৫ PDF bdnewspost.com চুয়েটে ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট আয়োজন করেছে হুয়াওয়ে bdnewspost.com SSC English 2d Paper Query Solution 2025 – SSC English 2d Paper Query answer 2025 PDF Obtain bdnewspost.com এসএসসি ইংরেজি ২য় পত্র প্রশ্ন সমাধান ২০২৫ PDF সব বোর্ড ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও সিলেট বোর্ড bdnewspost.com ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরী মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৫ bdnewspost.com দাখিল আরবি ২য় পত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ও সমাধান ২০২৫ PDF bdnewspost.com SSC English 1st Paper Query resolution 2025 – SSC English 1st Paper Query Resolution 2025 PDF Obtain All Board bdnewspost.com কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা (পশ্চিম) নিয়োগ VAT Dhaka West Task Round 2025 bdnewspost.com

যাকাত: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক bdnewspost.com

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:৪৬:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫ ২৮ বার পড়া হয়েছে


Ads

ইরশাদ হচ্ছে নিশ্চয়ই যারা সত্যে বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তাদের প্রতিফল তাদের প্রতিপালকের কাছে সংরক্ষিত। তাদের কোনো ভয় বা পেরেশানি থাকবে না। (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৭৭)


এক নজরে এই পোষ্টে কি কি থাকছে দেখে নিনঃ

যাকাত শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত ঐ সম্পদকে বলে, যা নিজের সকল প্রকার সুবিধা নিঃশেষ করার পর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য এমন কোন ফকিরকে দিয়ে দেয়া, যে না স্বয়ং হাশেমী বংশীয়, না হাশেমী বংশের আযাদকৃত গোলাম। যাকাত ২য় হিজরীতে রোযার পূর্বে ফরয হয়েছিলো।  অনেকর ধারণা যাকাত দিলে গচ্ছিত সম্পদ কমে যায়, বস্তুত  যাকাত প্রদানে সম্পদ কমে না বরং সম্পদ পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পায়। তাই যাকাত প্রদানকারীর এই বিশ্বাস রেখে সন্তুষ্টি চিত্তে যাকাত প্রদান করা উচিৎ যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদান দান করবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সদকার দ্বারা সম্পদ কমে না।  যদিওবা প্রকাশ্যভাবে সম্পদ কমে যায় বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন গাছের পঁচে যাওয়া ডালপালা কাটার ফলে প্রকাশ্যভাবে গাছকে দেখতে ছোট মনে হয়, কিন্তু এই কর্তন তার ক্রম-বিকাশের অন্যতম উপায়। বক্ষমান নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনার প্রয়াস পেলাম। আরো দেখুনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

যাকাত কাদের উপর ফরয

সাবালক সজ্ঞান মুসলমান নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা বা ৮৭ গ্রাম স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য বা ৬১২.৩৫ গ্রাম কিংবা তার সমপরিমাণ সম্পদের টাকা অথবা ঐ পরিমাণ টাকার ব্যবসায়িক মাল) সম্পদের মালিক হওয়ার পর চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয়। আর তা তার মৌলিক চাহিদা (তথা জীবন অতিবাহিত করার প্রয়োজনিয় বিষয়াবলী) হতে অতিরিক্ত হতে হবে। তাছাড়া এরূপ ঋণও না থাকে যে, যদি সেই ঋণ আদায় করে, তবে তার নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে না।  নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার দিন থেকে এক বছর পুর্তির পর যাকাতযোগ্য মালের বর্তমান বাজার দর হিসেবে ঐ সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ (অর্থাৎ ২.৫%) যাকাত হিসেবে নির্দিষ্ট শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের মাঝে বন্টন করা ফরয।

যাকাতের ‘নিসাব পরিমাণ’

যাকাতের ‘নিসাব পরিমাণ’ বিভিন্ন দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। নিচে এ সংক্রাস্ত বিস্তারিত দেয়া হলো-
১.নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা এবং ব্যবসায়িক পণ্য ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান স¤পূর্ণ মূল্যের ২.৫%
স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা সোনা-রূপার অলংকার সোনা ৭.৫ তোলা এবং রূপা ৫২.৫ তোলা সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫%।
২. কৃষিজাত দ্রব্যের ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, যেকোনো পরিমাণ; অন্যান্যদের মতে, ৫ ওয়াসাক বা ২৬ মণ১০ সের; ইসলামিক ইকোলজিক্যাল রিসার্চ ব্যুরো’র মতে, ১৫৬৮ কেজি বৃষ্টিতে উৎপাদিত দ্রব্যের ১০% খনিজ দ্রব্য যেকোনো পরিমাণ দ্রব্যের ২০%
৩. ভেড়া-ছাগলের ক্ষেত্রে ক) ৪০-১২০টিতে ১টি ভেড়া বা ছাগল।
খ) ১২১-২০০টিতে ২টি ভেড়া বা ছাগল।
গ) ২০১-৪০০টিতে ৩টি ভেড়া বা ছাগল।
ঘ) ৪০০-৪৯৯টিতে ৪টি ভেড়া বা ছাগল
ঙ) ৫০০ বা ততোধিক হলে ৫টি ভেড়া অর্থাৎ এরপর  প্রতি শ’তে ১টি করে বৃদ্ধি হারে নির্ধারিত হবে।
৪. গরু-মহিষ ৩০-৩৯টিতে ১টি এক বছরের বাছুর,
৪০-৪৯টিতে ১টি দুই বছরের বাছুর,
৫০-৫৯টিতে ২টি দুই বছরের বাছুর,
৬০-৬৯টিতে ১টি তিন বছরের এবং ১টি দুই বছরের বাছুর,
৭০-৭৯টিতে ২টি তিন বছরের বাছুর,
৮০-৮৯টিতে ৩টি দুই বছরের বাছুর,
৯০-৯৯টিতে ১টি তিন বছরের এবং ২টি দুই বছরের বাছুর,
১০০-১১৯টিতে দুই বছরের বাছুর -এভাবে ঊর্ধ্বে হিসাব হবে।
৫. উট নিম্নোক্ত হিসাবে
ক) ৫-৯টিতে ১টি তিন বছরের খাশি অথবা ১টি এক বছরের বকরি,
খ) ১০-১৪টিতে ২টি এক বছরের বকরি,
গ) ১৫-১৯টিতে ৩টি এক বছরের বকরি,
ঘ) ২০-২৪টিতে ৪টি এক বছরের বকরি,
ঙ) ২৫-৩৫টিতে ৪টি এক বছরের মাদী উট,
চ) ৩৬-৪৫টিতে ২টি তিন বছরের মাদী উট,
ছ) ৪৬-৬০টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট,
জ) ৬১-৭৫টিতে ১টি পাঁচ বছরের মাদী উট,
ঝ) ৭৬-৯০টিতে ২টি তিন বছরের মাদী উট,
ঞ) ৯১-১২০টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট,
ট) ১২১-১২৯টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ১টি ছাগল,
ঠ) ১৩০-১৩৪টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ২টি ছাগল,
ড) ১৩৫-১৩৯টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ৩টি ছাগল,
ঢ) ১৪০-১৪৪টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ৪টি ছাগল,
দ) ১৪৫-১৪৯টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ১টি দুই বছরের উট,
ধ)১৫০ এবং তদুর্ধ্ব হলে ৩টি ৪ বছরের মাদী উট এবং প্রতি ৫টিতে ১টি ছাগল।

৬. ঘোড়া (এক্ষেত্রে তিনটি মত পাওয়া যায়) যাকাত নেই কিংবা সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫% কিংবা প্রতিটি ঘোড়ার জন্য ১ দিনার পরিমাণ অর্থ দিতে হবে।
৭. শেয়ার, ব্যাংক নোট, স্টক ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫%, তবে
কোম্পানী যাকাত দিলে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দিতে হবে না
৮. অংশীদারী কারবার ও মুদারাবার ক্ষেত্রে ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান প্রথমে সম্পত্তির যাকাত দিতে হবে, মূলধনের নয়; এরপর লাভ বন্টিত হবে। যাকাত ব্যক্তিগতভাবে লাভের উপর হবে, একভাগ (২.৫%)  দিবে মূলধন সরবরাহকারী এবং একভাগ (২.৫%) দিবে শ্রমদানকারী।

উল্লেখ্য যে, কোন প্রকার সম্পদ স্বতন্ত্রভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়ে একাধিক প্রকারের অল্প অল্প হয়ে সমষ্টিগতভাবে মূল্য হিসাবে ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের মূল্য সমপরিমাণ হলেও যাকাত প্রযোজ্য হবে।

একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি (যেমন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে) নেসাবের মালিক হলে প্রত্যেককেই স্বতন্ত্রভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যাকাত স্বামীর উপর বর্তায় না, তেমনিভাবে সস্তানদের যাকাত পিতার উপর বর্তায় না। তবে কেউ যদি অন্যের অনুমতিক্রমে তার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাত বন্টনের খাত

যাকাত সঠিকভাবে বন্টনের উপর গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই যাকাত বন্টনের খাতসমুহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।  ইরশাদ হচ্ছে-

اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْعٰمِلِیْنَ عَلَیْهَا وَ الْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الْغٰرِمِیْنَ وَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ ؕ فَرِیْضَةً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ۝۶۰

অর্থাৎ যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।(সূরা তাওবা, আয়াত: ৬০)

উপর্যুক্ত আয়াতে করিমার আলোকে ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদদের মতে আট শ্রেণির মানুষকে যাকাত প্রদান করা যাবে।  যথা:

১. ফকীর: যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য  মাল আছে, অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরীব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
২. মিসকীন: অভাবগ্রস্থ যার কিছুই নেই।
৩. যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারী: ইসলামী সরকারের পক্ষে লোকদের নিকট থেকে যাকাত, উসর প্রভৃতি আদায় করে বায়তুল মালে জমা প্রদান, সংরক্ষণ ও বন্টন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই পয়েন্ট ব্যবহার করে  কতেক মানুষ বড় পরিমাণে যাকাতের টাকা কালেকশন করে দিয়েছে মর্মে শতকরা ( %)  গ্রহণ করে। অথচ তাদের মাসিক ইনকাম পঞ্চাশ হাজারের অধিক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পূর্বের যুগে  বিজ্ঞজনেরা নিজেরা যথাযথভাবে যাকাত প্রদান করে অন্যদেরকে উৎসাহিত করতো। আল্লাহ তায়ালা হেদায়ত নসিব করুন।
৪. মুয়াল্লিফাতুল কুলুব: নব মুসলিম যার ঈমান এখনও পরিপক্ষ হয়নি অথবা ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক অমুসলিম।
৫. ক্রীতদাস/ বন্দী মুক্তি: ক্রীতদাস কিংবা অন্যায়ভাবে কোন নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তি বন্দী হলে তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা যাবে।
৬. ঋণগ্রস্থ: ঐ ব্যক্তি যার ঋণ পরিশোধের সম্পদ নেই  কিংবা যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্থ যে, ঋণ পরিশোধ করার পর মৌলিক চাহিদা মেটানোর সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৭. আল্লাহর পথে: সম্বলহীন মুজাহিদ, অসহায় গরীব দ্বীনি শিক্ষারত শিক্ষার্থী এবং ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত অসচ্ছল ব্যক্তিবর্গ।
৮. মুসাফির: এমন মুসাফির যিনি অর্থ কষ্টে নিপতিত। কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা  মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে।  তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েয, এর বেশি নয়।

উল্লেখ্য যে, গরীব আত্মীয়-স্বজনকেও যাকাতের মাল দেয়া যায় বরং তাদেরকেই আগে দেওয়া উচিত। অবশ্য তাদেরকে হাদিয়া বলে দেয়া ভালো যাতে তারা মনে কষ্ট না পায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৬০,৭১৬১,৭১৬৪,৭১৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪২-৫৪৬

তবে  তালিবে ইলমের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদেরকে যাকাতের বড় অংশ দেয়া উচিৎ তাতে যাকাত তো আদায় হবেই সেই সাথে কুরআনী তা‘লীমের সহযোগিতা করার দরুন ছদকায়ে জারিয়ার সাওয়াবও অর্জিত হবে।  যাকাতের টাকা এমন দরিদ্রকে দেওয়া উত্তম যে দ্বীনদার। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে। বর্তমানে যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত দেওয়ার পর যদি জানা যায় যে, যাকাত-গ্রহীতা অমুসলিম ছিল তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় যাকাত দিতে হবে। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস  ৭১৬৬,৭১৬৭, ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫১৬-৫১৭) কোনো লোককে যাকাতের উপযুক্ত মনে হওয়ায় তাকে যাকাত দেওয়া হল, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পেল যে, লোকটির নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাহলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দিতে হবে না। তবে যাকে যাকাত দেওয়া হয়েছে সে যদি জানতে পারে যে, এটা যাকাতের টাকা ছিল সেক্ষেত্রে তার ওপর তা ফেরৎ দেওয়া ওয়াজিব।

যে সব খাতে যাকাত দেয়া যাবে না

১. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
২. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে যাকাত আসে না যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস:৭১৫৬,মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস :১০৫৩৬ এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
৩. যে গরিব ব্যক্তির ব্যাপারে প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া  হলে লোকটি সে টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তবে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।
৪.যাকাতের টাকা যাকাতের হক্বদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ  নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুত-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
৫. যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।
৬. নিজ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা যাকাত দাতার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতিন এবং তাদের  অধস্তনকে নিজ সম্পদের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।+রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮)
৭. বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে যাকাত দেওয়া জায়েয যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না। কেউ কেউ কাজের লোক রাখার সময় বলে, মাসে এত টাকা করে পাবে আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে। এক্ষেত্রে ঈদের সময় দেওয়া টাকা যাকাত হিসাবে প্রদান করা যাবে না। সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে।
মোটকথা, যাকাতের টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না।(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৪৭,৬৯৪৮, ৭১৩৭,৭১৭০)

যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত

উপর্যুক্ত ব্যক্তিকে উক্ত সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়া। যেন সে আনন্দচিত্তে তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি যাকাতদাতা নিজের খুশি মতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকাটি খরচ করে যেমন, তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিল কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করল তাহলে যাকাত আদায় হবে না।(রদ্দুল মুহতার, ২/২৫৭) নিয়ম হল, যাকাতের টাকা দরিদ্র ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেওয়া। এরপর যদি সে নিজের খুশি মতো এসব কাজেই ব্যয় করে তাহলেও যাকাতদাতার যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাত প্রদানের ফযিলত

যাকাত দেয়ার উপকারীতা দুই ধরনের। প্রথমত: যাকাত প্রদানকারীর উপর আল্লাহর রহমত মুষলধারে বর্ষন হতে থাকে,   ও যাকাত প্রদানে খোদাভীরুতা অর্জিত হয়   এবং সফল ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।  দ্বিতীয়ত: যাকাত প্রদানকারীকে পবিত্র করে দেয়  এবং সম্পদের অনিষ্ট দূর হয়ে যায়।
১.যাকাত অন্তরে প্রশান্তি লাভের মাধ্যম : মানুষের সম্পদ যত বেশীই হোক না কেন, যদি তার কোন প্রতিবেশী অনাহারে দিনাতিপাত করে তাহলে সে কখনও তার অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারে না। বরং যখন তার সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ ঐ গরীব লোকটিকে দিয়ে সচ্ছল করে, তখন সে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করে।
২.যাকাত জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম:  রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِنَّ فِيْ الْجَنَّةِ لَغُرْفَةً، قَدْ يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا، وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا، أَعَدَّهَا اللهُ لِمَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَلاَنَ الْكَلاَمَ، وَتَابَعَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ-
অর্থাৎ ‘জান্নাতের মধ্যে এমন সব (মসৃণ) ঘর রয়েছে যার বাইরের জিনিস সমূহ ভিতর হতে এবং ভিতরের জিনিস সমূহ বাহির হতে দেখা যায়। সে সকল ঘরসমূহ আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির জন্য প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যে ব্যক্তি (মানুষের সাথে) নম্রতার সাথে কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে (যাকাত আদায় করে), নিয়মিত  রোযা রাখে এবং রাতে নামায আদায় করে অথচ মানুষ তখন ঘুমিয়ে থাকে’। (মুসনাদে আহমাদ হাদীস:১৩৫১; মিশকাত হাদীস:১২৩২)
৩. যাকাত মুসলিম ঐক্যের সোপান : যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এমনকি এটি সমগ্র মুসলিম জাতিকে একটি পরিবারে রূপান্তরিত করে। ধনীরা যখন গরীবদেরকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করে তখন গরীবরাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ধনীদের উপর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ফলে তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللهُ إِلَيْكَ ‘তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন’ (সূরা ক্বাছাছ,আয়াত: ৭৭)
৪.যাকাত মানুষকে অর্থনৈতিক পাপ থেকে রক্ষা করে : চুরি, ডাকাতিসহ অর্থ সম্পর্কিত অন্যান্য পাপ সমূহ থেকে মানুষকে রক্ষা করার অন্যতম মাধ্যম হল যাকাত। কেননা অর্থ সংকটের কারণেই মানুষ বাধ্য হয়ে চুরি-ডাকাতির মত জঘন্যতম অপরাধ করতে বাধ্য হয়। ধনীরা তাদের সম্পদ থেকে যাকাতের নির্দিষ্ট অংশ দ্বারা যখন গরীবরেদকে সহযোগিত করবে ও তাদের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে, তখন তারা অবশ্যই উল্লিখিত অপরাধ থেকে বিরত থাকবে।
৫.যাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায় : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ
অর্থাৎ  ‘আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না’ (সূরা বাক্বারা,আয়াত:২৭৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ-
অর্থাৎ ‘দান সম্পদ কমায় না; ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ কোন বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাস করেন না এবং যে কেহ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে উন্নত করেন’। (সহিহ মুসলিম, হাদীস: ২৫৮৮; মিশকাত, হাদীস:১৮৮৯)

যাকাত ত্যাগকারীর হুকুম

কেউ যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা যাকাত ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়াকে স্বীকার করে কিন্তু অজ্ঞতাবশত অথবা কৃপণতার কারণে যাকাত আদায় না করে তাহলে সে কবীরা গুনাহগার হবে। তবে তার থেকে জোরপূর্বক যাকাত আদায় করতে হবে।  প্রিয়নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ، وَيُقِيْمُوْا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوْا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوْا ذَلِكَ عَصَمُوْا مِنِّيْ دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ-
অর্থাৎ ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর নামায ক্বায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর ন্যাস্ত’। (সহিহ বুখারী, হাদীসঃ:২৫; মুসলিম, হাদীস:২২)
হযরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু  যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, وَاللهِ لَوْ مَنَعُوْنِيْ عَنَاقًا كَانُوْا يُؤَدُّوْنَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهَا
অর্থাৎ ‘আল্লাহর শপথ! যদি তারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায় যা আল্লাহর রাসূলের কাছে তারা দিত, তাহলে যাকাত না দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব’। (সহিহ বুখারী, হাদীস:১৪০০)

যাকাত না দেয়ার কুফল

যারা কৃপণতাবশত যাকাত ফরয হওয়া সত্ত্বেও আদায় করে না তাদের জন্য রয়েছে দু’ধরনের শাস্তি।  যথা-
(ক) যাকাত অনাদায়কারীর পরকালীন শাস্তি : 
যাকাত অনাদায়ের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন ,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ، يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ-
অর্থাৎ ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় না করে তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। আর বলা হবে, এটাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর’ (সূরা তওবা,আয়াত:৩৪-৩৫) উপর্যুক্ত আয়াতে যাকাত আদায় না করার ভয়ংকর পরিণতির বর্ণনা উঠে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالاً، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ، لَهُ زَبِيْبَتَانِ، يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِى شِدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ-
অর্থাৎ ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্বে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র কুরআনুল করিমের নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন, وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَا آتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيْرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ অর্থাৎ ‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই ক্বিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করেছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে’। [ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত:১৮০) সহিহ বুখারী হাদীস:১৪০৩; মিশকাত হাদীস:১৭৭৪]
যাকাত অনাদায়ের ভয়াবহ পরিণতি প্রসঙ্গে অপর হাদিসে এভাবেই এসেছে, “যেসকল স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তার হক (যাকাত) আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে। এরপর তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে তা দিয়ে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠা-ঠা হয়ে যাবে, সাথে সাথে তা পুনরায় উত্তপ্ত করা হবে। সেদিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতদিন বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি না হয়, তার শাস্তি ততদিন চলমান থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয়ত জান্নাতের দিকে, নয়ত জাহান্নামের দিকে”। (সহিহ মুসলিম)
উপর্যুক্ত হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম নির্ধারণে এক যাকাতই যথেষ্ট।
(খ) যাকাত ত্যাগকারীর দুনিয়াবী শাস্তি : আল্লাহ তা‘আলা পরকালে যেমন যাকাত ত্যাগকারীর জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। তেমনিভাবে দুনিয়াতেও তাদের রয়েছে কঠিন পরিনতি। যারা যাকাত আদায় করে না, আল্লাহ তায়ালা তাদের অভাবে লিপ্ত করে দিবেন।  জলে ও স্থলে যে সম্পদ নষ্ট হয়, তা যাকাত না দেয়ার ফলেই নষ্ট হয়। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
وَلاَ مَنَعَ قَوْمٌ الزَّكَاةَ إِلاَّ حَبَسَ اللهُ عَنْهُمُ الْقَطْرَ ‘
অর্থাৎ যে জাতি যাকাত দেয় না, আল্লাহ তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন’। (সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৬৬২৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৭)

অর্থনৈতিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থাপনার সুফল

ইসলাম যাকাত নীতির মাধ্যমে সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আবার হালাল-হারামের শর্ত, বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে এক সুবিচার ও ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি উপহার দিয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যাকাত হলো, ‘‘বিত্তশালীদের উপর আরোপিত এক ধরনের সুনির্দিষ্ট কর।’’

ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর্যুক্ত পদ্ধতি এ নির্দেশ প্রদান করে যে, ধন-সম্পদ জমা ও সঞ্চয় করার জন্য নয়, বরং একে বণ্টন করতে হবে এবং (এক হাত থেকে অপর হাতে) চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে করে মানুষের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য অক্ষুন্ন থাকবে। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো ‘যাকাতের বিধান’। ইসলাম সীমিত পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকার করে নিলেও এ সুযোগে যেন অশুভ পুঁজিতন্ত্রের সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য অভাবী মানুষের প্রয়োজন এবং সামাজিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ঐ সঞ্চিত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালে জমা করার দাবী জানায় ইসলাম। এর এ দাবী ঐচ্ছিক পর্যায়ের নয়; বরং এ দাবী আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক এবং ধর্মীয়ভাবে অবশ্যই পালনীয় ফরযরূপে অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি তা আদায় না করে তার জন্য আইনগতভাবে শাস্তির সাথে সাথে রয়েছে  পরকালীন কঠিন আযাব।

যাকাতের আর্থ-সামাজিক প্রভাব

যাকাতের আর্থ-সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো:
১. দারিদ্র বিমোচন: দারিদ্র দু’প্রকার: ক) কর্মহীন দরিদ্র: কর্মহীন দরিদ্র তারাই যারা আসলেই বেকার, তাদের করার মত কিছুই নেই। এদেরকে মজুরী নির্ভরও বলা যেতে পারে। সত্যি বলতে কি এ শ্রেণির লোকদেরই যাকাতের অর্থ দরকার সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করা দরকার, এ ধরনের সাহায্য সহযোগিতার ফলে তারা সামান্য দ্রব্যসামগ্রী কিনতে সক্ষম হবে যা তাদের শুধু বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। এদের জন্য অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ গৃহীত না হলে কোনোভাবেই এরা দারিদ্রসীমার উপর উঠে আসতে পারবে না।
খ)কর্মরত দরিদ্র: অপরপক্ষে কর্মরত দরিদ্র হল তারা যারা কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত রয়েছে। যেমন, কৃষিপণ্য উৎপাদন, ছোট দোকান, ক্ষুদে ব্যবসা পরিচালনা কিংবা হাতের কাজ ইত্যাদি। যে কোনো কারণেই হোক তারা তাদের বর্তমান অবস্থান হতে কোনোক্রমেই আর সামনে এগুতে পারছে না। এসব লোকের জন্য চাই বিশেষ ধরনের সাহায্য সহযোগিতা, যাতে তারা স্ব স্ব পেশায় উৎপাদনের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এদেরকে প্রয়োজনীয় উকরণ সরবরাহ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে সাহায্য এবং প্রয়োজনীয় মূলধন যোগান দিতে হবে। যাকাতের অর্থের পরিকল্পিত ও যথাযথ ব্যবহার করা হলে উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের ইতিবাচক ভূমিকা পড়বেই।

২.সঞ্চয় ও বিনিয়োগ: যাকাত ব্যক্তির সম্পদ অলসভাবে ফেলে রাখার উপর এক ধরনের আর্থিক শাস্তি আরোপ করায় তাকে প্রকৃতপক্ষে সম্পদ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার বা বিনিয়োগ করতে বাধ্য করে। এর নীট ফল সঞ্চয়ের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, নেতিবাচক নয়। সুতরাং জোর দিয়েই বলা যায়, ইসলাম কোনো ব্যক্তির সঞ্চয় অলসভাবে ফেলে রাখতে বলে নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এর অনাকাঙ্খিত পরিণতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সেজন্যই তিনি ইয়াতিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণকারীদের তা বিনিয়োগ করতে বলেছেন যেন যাকাত আদায়ের ফলে তা ধীরে ধীরে কমে না আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নির্দেশ আমাদেরকে সম্পদ অলসভাবে ফেলে রাখার চেয়ে বরং তা ব্যবহারের ফলে যা আয় হয় তা থেকে যাকাত দেওয়ার শিক্ষা দেয়।
৩. স্থিতিশীলতা: যাকাতের মাধ্যমে যদি পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় তাহলে তা মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক কৌশল হিসেবে অধিকতর কার্যকর হবে যদি উপযুক্ত বণ্টননীতি গৃহীত হয়। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রাস্ফীতি চাপের সময়ে যাকাতের অর্থের বৃহত্তম অংশ মূলধনী পণ্য আকারে বিতরণ এবং মুদ্রা সংকোচনের সময়ে ভোগ্য দ্রব্য বা নগদ আকারেই তা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। অবশ্য এটা এক এক বার এক এক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে।
৪. উৎপাদন মিশ্রণ: সমাজের বিত্তশালী শ্রেণির নিকট হতে দরিদ্র শ্রেণীর কাছে যাকাতের মাধ্যমে স্বল্প হলেও ক্রয় ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। যেহেতু দরিদ্রদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশি সেহেতু এর ফলে দেশের সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এর সুপ্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। যদি বিত্তবানরা পরিকল্পিতভাবে এলাকার দুস্থ, বিধবা, সহায়-সম্বলহীন পরিবারের মধ্যে বাছাই করে প্রতি বছর অন্ততঃ তিন চারটি পরিবারকে নিজের পায়ে দাড়াবার জন্য রিক্সা, ভ্যান, নৌকা, সেলাইমেশিন কিংবা কয়েকটি ছাগল ইত্যাদি কিনে দেন তবে দেখা যাবে তাদের একার প্রচেষ্টাতেই পাঁচ বছরে তার এলাকায় অন্ততঃ ১০টি পরিবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অপরদিকে ভিক্ষুক ও অভাবী পরিবারের সংখ্যাও কমে আসবে। সমাজে বিদ্যমান অসহনীয় দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরসনকল্পে বর্তমান সময়ে যাকাতের অর্থ পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ করে একটি তহবিল গঠন এবং সেই তহবিল হতেই দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলি।

যাকাত, সাদাকাহ ও করের মধ্যকার পার্থক্য

যাকাত ও সাদাকাহ এর মাঝে একটু পার্থক্য আছে। কোনো সম্পদশালী ব্যক্তি তার মালের যাকাত আদায় করে দিলেই ইসলাম তাকে যাবতীয় সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত বলে মনে করে না; বরং সম্পদশালীদের জন্য জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিংবা বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ সম্পদ ব্যয়ের অন্য একটি দায়িত্ব মুমিনদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে, যাকে পরিভাষায় সাদাকাহ বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব দায়িত্ব পালন ইসলাম ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক বলে সাব্যস্ত করেছে। আবার কোনো কোনো পরিস্থিতিতে এটাকে নফল সাদাকাহ বলেছে। যাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সকল ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ ইসলামের এ মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক ঈমান ও সামাজিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু করের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধের অস্তিত্ব নেই। যাকাত হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অর্থ। সদকা হচ্ছে আল্লাহ নির্দেশিত ঐচ্ছিক প্রদেয় অর্থ। কর হচ্ছে  সরকার আরোপিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অর্থ। যাকাত শুধু দরিদ্রদের হক পক্ষান্তরে কর থেকে অর্জিত সম্পদ থেকে দেশের সকল নাগরিকের স্বার্থে ব্যয় করা হয়।

একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। এর আড়াই শতাংশ হারে যাকাতের পরিমাণ হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২৫ হাজার কোটির জায়গায় যদি ১২ হাজার কোটি টাকাও বছরে যাকাত আদায় হয়, তাহলে তা দিয়ে প্রতিটি ১০০ কোটি টাকা করে ১২০টি সমন্বিত ফলজ, বনজ, মৎস্য ও পশুসম্পদ প্রকল্প হাতে নেয়া যাবে। প্রতিবছর ১২০টি করে ১০ বছরে ১২০০টি এবং বছর বছর এই থেকে প্রবৃদ্ধি আমাদের দেশ থেকে দারিদ্রকে করবে পুরোপুরি নির্বাসিত। দেশের সকল যাকাত গ্রহীতা রূপান্তরিত হবে যাকাতদাতায়। সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায় করলে আগামী ১৫ বছরের ভেতরেই সম্ভব এই লক্ষ্য অর্জন করা। আসুন, বিত্তবানরা প্রতিজ্ঞা করি পরিকল্পিতভাবে যথাযথভাবে যাকাত পরিশোধ করে অর্থনৈতিক  সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়ি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন আমীন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।


নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

যাকাত: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক bdnewspost.com

আপডেট সময় : ১২:৪৬:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫


Ads

ইরশাদ হচ্ছে নিশ্চয়ই যারা সত্যে বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তাদের প্রতিফল তাদের প্রতিপালকের কাছে সংরক্ষিত। তাদের কোনো ভয় বা পেরেশানি থাকবে না। (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৭৭)


এক নজরে এই পোষ্টে কি কি থাকছে দেখে নিনঃ

যাকাত শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত ঐ সম্পদকে বলে, যা নিজের সকল প্রকার সুবিধা নিঃশেষ করার পর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য এমন কোন ফকিরকে দিয়ে দেয়া, যে না স্বয়ং হাশেমী বংশীয়, না হাশেমী বংশের আযাদকৃত গোলাম। যাকাত ২য় হিজরীতে রোযার পূর্বে ফরয হয়েছিলো।  অনেকর ধারণা যাকাত দিলে গচ্ছিত সম্পদ কমে যায়, বস্তুত  যাকাত প্রদানে সম্পদ কমে না বরং সম্পদ পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পায়। তাই যাকাত প্রদানকারীর এই বিশ্বাস রেখে সন্তুষ্টি চিত্তে যাকাত প্রদান করা উচিৎ যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদান দান করবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সদকার দ্বারা সম্পদ কমে না।  যদিওবা প্রকাশ্যভাবে সম্পদ কমে যায় বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন গাছের পঁচে যাওয়া ডালপালা কাটার ফলে প্রকাশ্যভাবে গাছকে দেখতে ছোট মনে হয়, কিন্তু এই কর্তন তার ক্রম-বিকাশের অন্যতম উপায়। বক্ষমান নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনার প্রয়াস পেলাম। আরো দেখুনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

যাকাত কাদের উপর ফরয

সাবালক সজ্ঞান মুসলমান নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা বা ৮৭ গ্রাম স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য বা ৬১২.৩৫ গ্রাম কিংবা তার সমপরিমাণ সম্পদের টাকা অথবা ঐ পরিমাণ টাকার ব্যবসায়িক মাল) সম্পদের মালিক হওয়ার পর চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয়। আর তা তার মৌলিক চাহিদা (তথা জীবন অতিবাহিত করার প্রয়োজনিয় বিষয়াবলী) হতে অতিরিক্ত হতে হবে। তাছাড়া এরূপ ঋণও না থাকে যে, যদি সেই ঋণ আদায় করে, তবে তার নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে না।  নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার দিন থেকে এক বছর পুর্তির পর যাকাতযোগ্য মালের বর্তমান বাজার দর হিসেবে ঐ সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ (অর্থাৎ ২.৫%) যাকাত হিসেবে নির্দিষ্ট শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের মাঝে বন্টন করা ফরয।

যাকাতের ‘নিসাব পরিমাণ’

যাকাতের ‘নিসাব পরিমাণ’ বিভিন্ন দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। নিচে এ সংক্রাস্ত বিস্তারিত দেয়া হলো-
১.নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা এবং ব্যবসায়িক পণ্য ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান স¤পূর্ণ মূল্যের ২.৫%
স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা সোনা-রূপার অলংকার সোনা ৭.৫ তোলা এবং রূপা ৫২.৫ তোলা সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫%।
২. কৃষিজাত দ্রব্যের ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, যেকোনো পরিমাণ; অন্যান্যদের মতে, ৫ ওয়াসাক বা ২৬ মণ১০ সের; ইসলামিক ইকোলজিক্যাল রিসার্চ ব্যুরো’র মতে, ১৫৬৮ কেজি বৃষ্টিতে উৎপাদিত দ্রব্যের ১০% খনিজ দ্রব্য যেকোনো পরিমাণ দ্রব্যের ২০%
৩. ভেড়া-ছাগলের ক্ষেত্রে ক) ৪০-১২০টিতে ১টি ভেড়া বা ছাগল।
খ) ১২১-২০০টিতে ২টি ভেড়া বা ছাগল।
গ) ২০১-৪০০টিতে ৩টি ভেড়া বা ছাগল।
ঘ) ৪০০-৪৯৯টিতে ৪টি ভেড়া বা ছাগল
ঙ) ৫০০ বা ততোধিক হলে ৫টি ভেড়া অর্থাৎ এরপর  প্রতি শ’তে ১টি করে বৃদ্ধি হারে নির্ধারিত হবে।
৪. গরু-মহিষ ৩০-৩৯টিতে ১টি এক বছরের বাছুর,
৪০-৪৯টিতে ১টি দুই বছরের বাছুর,
৫০-৫৯টিতে ২টি দুই বছরের বাছুর,
৬০-৬৯টিতে ১টি তিন বছরের এবং ১টি দুই বছরের বাছুর,
৭০-৭৯টিতে ২টি তিন বছরের বাছুর,
৮০-৮৯টিতে ৩টি দুই বছরের বাছুর,
৯০-৯৯টিতে ১টি তিন বছরের এবং ২টি দুই বছরের বাছুর,
১০০-১১৯টিতে দুই বছরের বাছুর -এভাবে ঊর্ধ্বে হিসাব হবে।
৫. উট নিম্নোক্ত হিসাবে
ক) ৫-৯টিতে ১টি তিন বছরের খাশি অথবা ১টি এক বছরের বকরি,
খ) ১০-১৪টিতে ২টি এক বছরের বকরি,
গ) ১৫-১৯টিতে ৩টি এক বছরের বকরি,
ঘ) ২০-২৪টিতে ৪টি এক বছরের বকরি,
ঙ) ২৫-৩৫টিতে ৪টি এক বছরের মাদী উট,
চ) ৩৬-৪৫টিতে ২টি তিন বছরের মাদী উট,
ছ) ৪৬-৬০টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট,
জ) ৬১-৭৫টিতে ১টি পাঁচ বছরের মাদী উট,
ঝ) ৭৬-৯০টিতে ২টি তিন বছরের মাদী উট,
ঞ) ৯১-১২০টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট,
ট) ১২১-১২৯টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ১টি ছাগল,
ঠ) ১৩০-১৩৪টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ২টি ছাগল,
ড) ১৩৫-১৩৯টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ৩টি ছাগল,
ঢ) ১৪০-১৪৪টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ৪টি ছাগল,
দ) ১৪৫-১৪৯টিতে ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ১টি দুই বছরের উট,
ধ)১৫০ এবং তদুর্ধ্ব হলে ৩টি ৪ বছরের মাদী উট এবং প্রতি ৫টিতে ১টি ছাগল।

৬. ঘোড়া (এক্ষেত্রে তিনটি মত পাওয়া যায়) যাকাত নেই কিংবা সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫% কিংবা প্রতিটি ঘোড়ার জন্য ১ দিনার পরিমাণ অর্থ দিতে হবে।
৭. শেয়ার, ব্যাংক নোট, স্টক ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫%, তবে
কোম্পানী যাকাত দিলে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দিতে হবে না
৮. অংশীদারী কারবার ও মুদারাবার ক্ষেত্রে ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান প্রথমে সম্পত্তির যাকাত দিতে হবে, মূলধনের নয়; এরপর লাভ বন্টিত হবে। যাকাত ব্যক্তিগতভাবে লাভের উপর হবে, একভাগ (২.৫%)  দিবে মূলধন সরবরাহকারী এবং একভাগ (২.৫%) দিবে শ্রমদানকারী।

উল্লেখ্য যে, কোন প্রকার সম্পদ স্বতন্ত্রভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়ে একাধিক প্রকারের অল্প অল্প হয়ে সমষ্টিগতভাবে মূল্য হিসাবে ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের মূল্য সমপরিমাণ হলেও যাকাত প্রযোজ্য হবে।

একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি (যেমন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে) নেসাবের মালিক হলে প্রত্যেককেই স্বতন্ত্রভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যাকাত স্বামীর উপর বর্তায় না, তেমনিভাবে সস্তানদের যাকাত পিতার উপর বর্তায় না। তবে কেউ যদি অন্যের অনুমতিক্রমে তার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাত বন্টনের খাত

যাকাত সঠিকভাবে বন্টনের উপর গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই যাকাত বন্টনের খাতসমুহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।  ইরশাদ হচ্ছে-

اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْعٰمِلِیْنَ عَلَیْهَا وَ الْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الْغٰرِمِیْنَ وَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ ؕ فَرِیْضَةً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ۝۶۰

অর্থাৎ যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।(সূরা তাওবা, আয়াত: ৬০)

উপর্যুক্ত আয়াতে করিমার আলোকে ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদদের মতে আট শ্রেণির মানুষকে যাকাত প্রদান করা যাবে।  যথা:

১. ফকীর: যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য  মাল আছে, অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরীব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
২. মিসকীন: অভাবগ্রস্থ যার কিছুই নেই।
৩. যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারী: ইসলামী সরকারের পক্ষে লোকদের নিকট থেকে যাকাত, উসর প্রভৃতি আদায় করে বায়তুল মালে জমা প্রদান, সংরক্ষণ ও বন্টন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই পয়েন্ট ব্যবহার করে  কতেক মানুষ বড় পরিমাণে যাকাতের টাকা কালেকশন করে দিয়েছে মর্মে শতকরা ( %)  গ্রহণ করে। অথচ তাদের মাসিক ইনকাম পঞ্চাশ হাজারের অধিক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পূর্বের যুগে  বিজ্ঞজনেরা নিজেরা যথাযথভাবে যাকাত প্রদান করে অন্যদেরকে উৎসাহিত করতো। আল্লাহ তায়ালা হেদায়ত নসিব করুন।
৪. মুয়াল্লিফাতুল কুলুব: নব মুসলিম যার ঈমান এখনও পরিপক্ষ হয়নি অথবা ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক অমুসলিম।
৫. ক্রীতদাস/ বন্দী মুক্তি: ক্রীতদাস কিংবা অন্যায়ভাবে কোন নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তি বন্দী হলে তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা যাবে।
৬. ঋণগ্রস্থ: ঐ ব্যক্তি যার ঋণ পরিশোধের সম্পদ নেই  কিংবা যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্থ যে, ঋণ পরিশোধ করার পর মৌলিক চাহিদা মেটানোর সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৭. আল্লাহর পথে: সম্বলহীন মুজাহিদ, অসহায় গরীব দ্বীনি শিক্ষারত শিক্ষার্থী এবং ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত অসচ্ছল ব্যক্তিবর্গ।
৮. মুসাফির: এমন মুসাফির যিনি অর্থ কষ্টে নিপতিত। কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা  মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে।  তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েয, এর বেশি নয়।

উল্লেখ্য যে, গরীব আত্মীয়-স্বজনকেও যাকাতের মাল দেয়া যায় বরং তাদেরকেই আগে দেওয়া উচিত। অবশ্য তাদেরকে হাদিয়া বলে দেয়া ভালো যাতে তারা মনে কষ্ট না পায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৬০,৭১৬১,৭১৬৪,৭১৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪২-৫৪৬

তবে  তালিবে ইলমের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদেরকে যাকাতের বড় অংশ দেয়া উচিৎ তাতে যাকাত তো আদায় হবেই সেই সাথে কুরআনী তা‘লীমের সহযোগিতা করার দরুন ছদকায়ে জারিয়ার সাওয়াবও অর্জিত হবে।  যাকাতের টাকা এমন দরিদ্রকে দেওয়া উত্তম যে দ্বীনদার। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে। বর্তমানে যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত দেওয়ার পর যদি জানা যায় যে, যাকাত-গ্রহীতা অমুসলিম ছিল তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় যাকাত দিতে হবে। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস  ৭১৬৬,৭১৬৭, ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫১৬-৫১৭) কোনো লোককে যাকাতের উপযুক্ত মনে হওয়ায় তাকে যাকাত দেওয়া হল, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পেল যে, লোকটির নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাহলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দিতে হবে না। তবে যাকে যাকাত দেওয়া হয়েছে সে যদি জানতে পারে যে, এটা যাকাতের টাকা ছিল সেক্ষেত্রে তার ওপর তা ফেরৎ দেওয়া ওয়াজিব।

যে সব খাতে যাকাত দেয়া যাবে না

১. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
২. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে যাকাত আসে না যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস:৭১৫৬,মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস :১০৫৩৬ এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
৩. যে গরিব ব্যক্তির ব্যাপারে প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া  হলে লোকটি সে টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তবে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।
৪.যাকাতের টাকা যাকাতের হক্বদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ  নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুত-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
৫. যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।
৬. নিজ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা যাকাত দাতার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতিন এবং তাদের  অধস্তনকে নিজ সম্পদের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।+রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮)
৭. বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে যাকাত দেওয়া জায়েয যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না। কেউ কেউ কাজের লোক রাখার সময় বলে, মাসে এত টাকা করে পাবে আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে। এক্ষেত্রে ঈদের সময় দেওয়া টাকা যাকাত হিসাবে প্রদান করা যাবে না। সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে।
মোটকথা, যাকাতের টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না।(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৪৭,৬৯৪৮, ৭১৩৭,৭১৭০)

যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত

উপর্যুক্ত ব্যক্তিকে উক্ত সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়া। যেন সে আনন্দচিত্তে তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি যাকাতদাতা নিজের খুশি মতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকাটি খরচ করে যেমন, তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিল কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করল তাহলে যাকাত আদায় হবে না।(রদ্দুল মুহতার, ২/২৫৭) নিয়ম হল, যাকাতের টাকা দরিদ্র ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেওয়া। এরপর যদি সে নিজের খুশি মতো এসব কাজেই ব্যয় করে তাহলেও যাকাতদাতার যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাত প্রদানের ফযিলত

যাকাত দেয়ার উপকারীতা দুই ধরনের। প্রথমত: যাকাত প্রদানকারীর উপর আল্লাহর রহমত মুষলধারে বর্ষন হতে থাকে,   ও যাকাত প্রদানে খোদাভীরুতা অর্জিত হয়   এবং সফল ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।  দ্বিতীয়ত: যাকাত প্রদানকারীকে পবিত্র করে দেয়  এবং সম্পদের অনিষ্ট দূর হয়ে যায়।
১.যাকাত অন্তরে প্রশান্তি লাভের মাধ্যম : মানুষের সম্পদ যত বেশীই হোক না কেন, যদি তার কোন প্রতিবেশী অনাহারে দিনাতিপাত করে তাহলে সে কখনও তার অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারে না। বরং যখন তার সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ ঐ গরীব লোকটিকে দিয়ে সচ্ছল করে, তখন সে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করে।
২.যাকাত জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম:  রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِنَّ فِيْ الْجَنَّةِ لَغُرْفَةً، قَدْ يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا، وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا، أَعَدَّهَا اللهُ لِمَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَلاَنَ الْكَلاَمَ، وَتَابَعَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ-
অর্থাৎ ‘জান্নাতের মধ্যে এমন সব (মসৃণ) ঘর রয়েছে যার বাইরের জিনিস সমূহ ভিতর হতে এবং ভিতরের জিনিস সমূহ বাহির হতে দেখা যায়। সে সকল ঘরসমূহ আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির জন্য প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যে ব্যক্তি (মানুষের সাথে) নম্রতার সাথে কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে (যাকাত আদায় করে), নিয়মিত  রোযা রাখে এবং রাতে নামায আদায় করে অথচ মানুষ তখন ঘুমিয়ে থাকে’। (মুসনাদে আহমাদ হাদীস:১৩৫১; মিশকাত হাদীস:১২৩২)
৩. যাকাত মুসলিম ঐক্যের সোপান : যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এমনকি এটি সমগ্র মুসলিম জাতিকে একটি পরিবারে রূপান্তরিত করে। ধনীরা যখন গরীবদেরকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করে তখন গরীবরাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ধনীদের উপর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ফলে তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللهُ إِلَيْكَ ‘তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন’ (সূরা ক্বাছাছ,আয়াত: ৭৭)
৪.যাকাত মানুষকে অর্থনৈতিক পাপ থেকে রক্ষা করে : চুরি, ডাকাতিসহ অর্থ সম্পর্কিত অন্যান্য পাপ সমূহ থেকে মানুষকে রক্ষা করার অন্যতম মাধ্যম হল যাকাত। কেননা অর্থ সংকটের কারণেই মানুষ বাধ্য হয়ে চুরি-ডাকাতির মত জঘন্যতম অপরাধ করতে বাধ্য হয়। ধনীরা তাদের সম্পদ থেকে যাকাতের নির্দিষ্ট অংশ দ্বারা যখন গরীবরেদকে সহযোগিত করবে ও তাদের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে, তখন তারা অবশ্যই উল্লিখিত অপরাধ থেকে বিরত থাকবে।
৫.যাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায় : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ
অর্থাৎ  ‘আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না’ (সূরা বাক্বারা,আয়াত:২৭৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ-
অর্থাৎ ‘দান সম্পদ কমায় না; ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ কোন বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাস করেন না এবং যে কেহ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে উন্নত করেন’। (সহিহ মুসলিম, হাদীস: ২৫৮৮; মিশকাত, হাদীস:১৮৮৯)

যাকাত ত্যাগকারীর হুকুম

কেউ যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা যাকাত ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়াকে স্বীকার করে কিন্তু অজ্ঞতাবশত অথবা কৃপণতার কারণে যাকাত আদায় না করে তাহলে সে কবীরা গুনাহগার হবে। তবে তার থেকে জোরপূর্বক যাকাত আদায় করতে হবে।  প্রিয়নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ، وَيُقِيْمُوْا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوْا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوْا ذَلِكَ عَصَمُوْا مِنِّيْ دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ-
অর্থাৎ ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর নামায ক্বায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর ন্যাস্ত’। (সহিহ বুখারী, হাদীসঃ:২৫; মুসলিম, হাদীস:২২)
হযরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু  যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, وَاللهِ لَوْ مَنَعُوْنِيْ عَنَاقًا كَانُوْا يُؤَدُّوْنَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهَا
অর্থাৎ ‘আল্লাহর শপথ! যদি তারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায় যা আল্লাহর রাসূলের কাছে তারা দিত, তাহলে যাকাত না দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব’। (সহিহ বুখারী, হাদীস:১৪০০)

যাকাত না দেয়ার কুফল

যারা কৃপণতাবশত যাকাত ফরয হওয়া সত্ত্বেও আদায় করে না তাদের জন্য রয়েছে দু’ধরনের শাস্তি।  যথা-
(ক) যাকাত অনাদায়কারীর পরকালীন শাস্তি : 
যাকাত অনাদায়ের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন ,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ، يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ-
অর্থাৎ ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় না করে তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। আর বলা হবে, এটাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর’ (সূরা তওবা,আয়াত:৩৪-৩৫) উপর্যুক্ত আয়াতে যাকাত আদায় না করার ভয়ংকর পরিণতির বর্ণনা উঠে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالاً، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ، لَهُ زَبِيْبَتَانِ، يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِى شِدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ-
অর্থাৎ ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্বে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র কুরআনুল করিমের নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন, وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَا آتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيْرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ অর্থাৎ ‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই ক্বিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করেছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে’। [ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত:১৮০) সহিহ বুখারী হাদীস:১৪০৩; মিশকাত হাদীস:১৭৭৪]
যাকাত অনাদায়ের ভয়াবহ পরিণতি প্রসঙ্গে অপর হাদিসে এভাবেই এসেছে, “যেসকল স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তার হক (যাকাত) আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে। এরপর তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে তা দিয়ে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠা-ঠা হয়ে যাবে, সাথে সাথে তা পুনরায় উত্তপ্ত করা হবে। সেদিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতদিন বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি না হয়, তার শাস্তি ততদিন চলমান থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয়ত জান্নাতের দিকে, নয়ত জাহান্নামের দিকে”। (সহিহ মুসলিম)
উপর্যুক্ত হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম নির্ধারণে এক যাকাতই যথেষ্ট।
(খ) যাকাত ত্যাগকারীর দুনিয়াবী শাস্তি : আল্লাহ তা‘আলা পরকালে যেমন যাকাত ত্যাগকারীর জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। তেমনিভাবে দুনিয়াতেও তাদের রয়েছে কঠিন পরিনতি। যারা যাকাত আদায় করে না, আল্লাহ তায়ালা তাদের অভাবে লিপ্ত করে দিবেন।  জলে ও স্থলে যে সম্পদ নষ্ট হয়, তা যাকাত না দেয়ার ফলেই নষ্ট হয়। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
وَلاَ مَنَعَ قَوْمٌ الزَّكَاةَ إِلاَّ حَبَسَ اللهُ عَنْهُمُ الْقَطْرَ ‘
অর্থাৎ যে জাতি যাকাত দেয় না, আল্লাহ তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন’। (সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৬৬২৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৭)

অর্থনৈতিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থাপনার সুফল

ইসলাম যাকাত নীতির মাধ্যমে সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আবার হালাল-হারামের শর্ত, বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে এক সুবিচার ও ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি উপহার দিয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যাকাত হলো, ‘‘বিত্তশালীদের উপর আরোপিত এক ধরনের সুনির্দিষ্ট কর।’’

ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর্যুক্ত পদ্ধতি এ নির্দেশ প্রদান করে যে, ধন-সম্পদ জমা ও সঞ্চয় করার জন্য নয়, বরং একে বণ্টন করতে হবে এবং (এক হাত থেকে অপর হাতে) চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে করে মানুষের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য অক্ষুন্ন থাকবে। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো ‘যাকাতের বিধান’। ইসলাম সীমিত পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকার করে নিলেও এ সুযোগে যেন অশুভ পুঁজিতন্ত্রের সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য অভাবী মানুষের প্রয়োজন এবং সামাজিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ঐ সঞ্চিত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালে জমা করার দাবী জানায় ইসলাম। এর এ দাবী ঐচ্ছিক পর্যায়ের নয়; বরং এ দাবী আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক এবং ধর্মীয়ভাবে অবশ্যই পালনীয় ফরযরূপে অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি তা আদায় না করে তার জন্য আইনগতভাবে শাস্তির সাথে সাথে রয়েছে  পরকালীন কঠিন আযাব।

যাকাতের আর্থ-সামাজিক প্রভাব

যাকাতের আর্থ-সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো:
১. দারিদ্র বিমোচন: দারিদ্র দু’প্রকার: ক) কর্মহীন দরিদ্র: কর্মহীন দরিদ্র তারাই যারা আসলেই বেকার, তাদের করার মত কিছুই নেই। এদেরকে মজুরী নির্ভরও বলা যেতে পারে। সত্যি বলতে কি এ শ্রেণির লোকদেরই যাকাতের অর্থ দরকার সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করা দরকার, এ ধরনের সাহায্য সহযোগিতার ফলে তারা সামান্য দ্রব্যসামগ্রী কিনতে সক্ষম হবে যা তাদের শুধু বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। এদের জন্য অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ গৃহীত না হলে কোনোভাবেই এরা দারিদ্রসীমার উপর উঠে আসতে পারবে না।
খ)কর্মরত দরিদ্র: অপরপক্ষে কর্মরত দরিদ্র হল তারা যারা কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত রয়েছে। যেমন, কৃষিপণ্য উৎপাদন, ছোট দোকান, ক্ষুদে ব্যবসা পরিচালনা কিংবা হাতের কাজ ইত্যাদি। যে কোনো কারণেই হোক তারা তাদের বর্তমান অবস্থান হতে কোনোক্রমেই আর সামনে এগুতে পারছে না। এসব লোকের জন্য চাই বিশেষ ধরনের সাহায্য সহযোগিতা, যাতে তারা স্ব স্ব পেশায় উৎপাদনের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এদেরকে প্রয়োজনীয় উকরণ সরবরাহ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে সাহায্য এবং প্রয়োজনীয় মূলধন যোগান দিতে হবে। যাকাতের অর্থের পরিকল্পিত ও যথাযথ ব্যবহার করা হলে উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের ইতিবাচক ভূমিকা পড়বেই।

২.সঞ্চয় ও বিনিয়োগ: যাকাত ব্যক্তির সম্পদ অলসভাবে ফেলে রাখার উপর এক ধরনের আর্থিক শাস্তি আরোপ করায় তাকে প্রকৃতপক্ষে সম্পদ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার বা বিনিয়োগ করতে বাধ্য করে। এর নীট ফল সঞ্চয়ের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, নেতিবাচক নয়। সুতরাং জোর দিয়েই বলা যায়, ইসলাম কোনো ব্যক্তির সঞ্চয় অলসভাবে ফেলে রাখতে বলে নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এর অনাকাঙ্খিত পরিণতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সেজন্যই তিনি ইয়াতিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণকারীদের তা বিনিয়োগ করতে বলেছেন যেন যাকাত আদায়ের ফলে তা ধীরে ধীরে কমে না আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নির্দেশ আমাদেরকে সম্পদ অলসভাবে ফেলে রাখার চেয়ে বরং তা ব্যবহারের ফলে যা আয় হয় তা থেকে যাকাত দেওয়ার শিক্ষা দেয়।
৩. স্থিতিশীলতা: যাকাতের মাধ্যমে যদি পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় তাহলে তা মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক কৌশল হিসেবে অধিকতর কার্যকর হবে যদি উপযুক্ত বণ্টননীতি গৃহীত হয়। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রাস্ফীতি চাপের সময়ে যাকাতের অর্থের বৃহত্তম অংশ মূলধনী পণ্য আকারে বিতরণ এবং মুদ্রা সংকোচনের সময়ে ভোগ্য দ্রব্য বা নগদ আকারেই তা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। অবশ্য এটা এক এক বার এক এক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে।
৪. উৎপাদন মিশ্রণ: সমাজের বিত্তশালী শ্রেণির নিকট হতে দরিদ্র শ্রেণীর কাছে যাকাতের মাধ্যমে স্বল্প হলেও ক্রয় ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। যেহেতু দরিদ্রদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশি সেহেতু এর ফলে দেশের সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এর সুপ্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। যদি বিত্তবানরা পরিকল্পিতভাবে এলাকার দুস্থ, বিধবা, সহায়-সম্বলহীন পরিবারের মধ্যে বাছাই করে প্রতি বছর অন্ততঃ তিন চারটি পরিবারকে নিজের পায়ে দাড়াবার জন্য রিক্সা, ভ্যান, নৌকা, সেলাইমেশিন কিংবা কয়েকটি ছাগল ইত্যাদি কিনে দেন তবে দেখা যাবে তাদের একার প্রচেষ্টাতেই পাঁচ বছরে তার এলাকায় অন্ততঃ ১০টি পরিবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অপরদিকে ভিক্ষুক ও অভাবী পরিবারের সংখ্যাও কমে আসবে। সমাজে বিদ্যমান অসহনীয় দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরসনকল্পে বর্তমান সময়ে যাকাতের অর্থ পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ করে একটি তহবিল গঠন এবং সেই তহবিল হতেই দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলি।

যাকাত, সাদাকাহ ও করের মধ্যকার পার্থক্য

যাকাত ও সাদাকাহ এর মাঝে একটু পার্থক্য আছে। কোনো সম্পদশালী ব্যক্তি তার মালের যাকাত আদায় করে দিলেই ইসলাম তাকে যাবতীয় সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত বলে মনে করে না; বরং সম্পদশালীদের জন্য জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিংবা বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ সম্পদ ব্যয়ের অন্য একটি দায়িত্ব মুমিনদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে, যাকে পরিভাষায় সাদাকাহ বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব দায়িত্ব পালন ইসলাম ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক বলে সাব্যস্ত করেছে। আবার কোনো কোনো পরিস্থিতিতে এটাকে নফল সাদাকাহ বলেছে। যাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সকল ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ ইসলামের এ মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক ঈমান ও সামাজিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু করের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধের অস্তিত্ব নেই। যাকাত হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অর্থ। সদকা হচ্ছে আল্লাহ নির্দেশিত ঐচ্ছিক প্রদেয় অর্থ। কর হচ্ছে  সরকার আরোপিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অর্থ। যাকাত শুধু দরিদ্রদের হক পক্ষান্তরে কর থেকে অর্জিত সম্পদ থেকে দেশের সকল নাগরিকের স্বার্থে ব্যয় করা হয়।

একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। এর আড়াই শতাংশ হারে যাকাতের পরিমাণ হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২৫ হাজার কোটির জায়গায় যদি ১২ হাজার কোটি টাকাও বছরে যাকাত আদায় হয়, তাহলে তা দিয়ে প্রতিটি ১০০ কোটি টাকা করে ১২০টি সমন্বিত ফলজ, বনজ, মৎস্য ও পশুসম্পদ প্রকল্প হাতে নেয়া যাবে। প্রতিবছর ১২০টি করে ১০ বছরে ১২০০টি এবং বছর বছর এই থেকে প্রবৃদ্ধি আমাদের দেশ থেকে দারিদ্রকে করবে পুরোপুরি নির্বাসিত। দেশের সকল যাকাত গ্রহীতা রূপান্তরিত হবে যাকাতদাতায়। সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায় করলে আগামী ১৫ বছরের ভেতরেই সম্ভব এই লক্ষ্য অর্জন করা। আসুন, বিত্তবানরা প্রতিজ্ঞা করি পরিকল্পিতভাবে যথাযথভাবে যাকাত পরিশোধ করে অর্থনৈতিক  সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়ি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন আমীন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।